ফোনটা
এল বিকেলে। রবিবার, ৫ জানুয়ারি। বাইরের কোনও কাজ রাখিনি সে দিন। বাড়িতে
বসে আমার আগামী বইয়ের জন্য লিখছিলাম। হঠাৎ বেলভিউ থেকে ফোনে মুনমুন। বলল,
“একটু কথা বলো।” তার পরেই এক বিমুগ্ধ বিস্ময় আমার জন্য ফোনের ও পারে তিনি,
সুচিত্রা সেন! গলাটা হয়তো একটু ভারী, তবে কথার মিষ্টতা আগের মতোই। আমাকে
বললেন, “চলে এসো, তোমাকে দেখতে চাই।” জানতে চাইলাম, “কবে? আজই, না কাল?”
জবাব এল, “এখুনি এসো। আজ ভাল আছি। কাল যদি ভাল না থাকি?”
ভাইপো অভিষেককে ডেকে নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। মনে অদ্ভুত
এক অনুভূতি কাজ করছিল। এর আগে কোনও দিন তাঁকে সামনে থেকে দেখিনি। পরিচয়
যা, সেটা পর্দায় দেখে। এবং যে কোনও বাঙালির মতোই উত্তম-সুচিত্রা জুটি
সম্পর্কে চিরাচরিত আবেগের আমিও শরিক। সেই সুচিত্রার সঙ্গে দেখা করতে
যাচ্ছি! সুচিত্রা সেন, আমাদের বিশ্বজয়ী দেবকন্যা! |
ঠিক দু’দিন আগেই জানতে পারি,
মহানায়িকা বেলভিউতে সুব্রত মৈত্রের চিকিৎসাধীন। সে দিনই নার্সিংহোমে খোঁজ
নিতে গিয়েছিলাম। তবে তিনি যে হেতু দীর্ঘদিন স্বেচ্ছায় নিজেকে আড়ালে
সরিয়ে রেখেছিলেন, তাই তাঁর সেই ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে দেখা করার চেষ্টা
করিনি। বাইরে থেকে মুনমুন, রাইমা, রিয়ার সঙ্গে কথা বলে ডাক্তার মৈত্র,
ডাক্তার সমরজিৎ নস্কর, বেলভিউয়ের সিইও প্রদীপ টন্ডনের কাছে সব খবরাখবর
নিয়ে ফিরে আসি। শুধু প্রার্থনা ছিল, ঈশ্বর ওনাকে দ্রুত সুস্থ করে তুলুন। এ
বার দেখা করার ডাক পাঠালেন ‘স্বপনচারিণী’ নিজেই।
মুনমুন, রাইমা, ডাক্তার মৈত্র আমাকে নিয়ে গেলেন। মনে হল, যেন আমারই জন্য
অপেক্ষা করছিলেন। প্রথম দেখা! সেই অনুভবটা ঠিক বলে বোঝানোর নয়। তাঁর
কেবিনে ঢুকতেই কাছে ডাকলেন। আমার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কত আদর
করলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, “খুব ভাল থেকো।” সে দিন আমারও
সুযোগ হয়েছিল তাঁর হাতে-পায়ে-গায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়ার। অনেক ক্ষণ কথাও
হয়েছিল। খানিকটা সময় তো একেবারে একান্তে আমরা দু’জনে। বেশ হাসিখুশি
সুচিত্রা সেনকে দেখে ফিরে এলাম। আসার আগে বললেন, “আবার এসো কিন্তু।”
এর পরে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁর নার্সিংহোমে থাকাকালীন আমি রোজ গিয়েছি,
শুধু এক দিন কলকাতায় ছিলাম না বলে যেতে পারিনি। বৃহস্পতিবারও সন্ধ্যায়
দেখা করে এসেছিলাম। শুক্রবার সকালে গিয়ে দাঁড়ালাম তাঁর নিথর দেহের সামনে
শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
তাঁকে দেখতে গিয়ে কোনও দিন ঘণ্টা দু’-তিন থাকতাম আমি। দ্বিতীয় যে দিন
তাঁর কাছে যাই, সে দিন তুলনামূলক ভাবে তাঁর শ্বাসকষ্ট একটু বেশি।
চিকিৎসকেরা বললেন, আমি থাকতে থাকতেই তাঁর রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে
গিয়েছে। কেন জানি না, আমি কাছে গেলে তাঁর রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা অর্থাৎ
স্যাচুরেশন বেড়ে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে যেত এমন কথা ডাক্তার মৈত্র
বৃহস্পতিবারেও বলেছেন। মুনমুন বলত, এটা কি মমতা-ম্যাজিক! তবে সে সবের মধ্যে
আমি যাচ্ছি না। আমার কাছে অনেক বড় পাওনা হল তাঁর সে দিনের একটি কথা:
“তুমি আমার কে হও?” কোনও কোনও সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমে কোনও ভাবে এই কথাটি
প্রকাশিত হয়ে যায় বিকৃত এক ইঙ্গিত দিয়ে। যাতে মনে হতে পারে, সুচিত্রা
সেন সে দিন এতই গুরুতর অবস্থায় ছিলেন যে, লোক চিনতে পারছিলেন না। খবর দেখে
হেসেছিলাম। কাকে কী বোঝাব! কিন্তু আজ বলছি, এটা অতি বড় ভুল ব্যাখ্যা।
আসলে স্নেহ-ভালবাসার কোন গভীর স্তর থেকে এমন কথা সে দিন তিনি বলেছিলেন, আমি
সেটা জানি। তাই উত্তরে আমিও বলেছিলাম, “আমি তো আপনার পরিবারেরই এক জন,
একেবারে আপন জন।” উনি হাসলেন। সারা মুখে শান্তির ছাপ।
সেই থেকে যত বার গিয়েছি, উনি কখনও কথা বলতে না-পারলেও ইশারায় কাছে
ডেকেছেন। হাত ধরে থেকেছেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। চা-কফি খেতে
বলেছেন। গত পরশুও যখন গেলাম মুনমুনের সামনেই উনি হাত বাড়ালেন। হাতে সূচ
ফুটিয়ে নানা রকম ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা, টিউব-পাইপ ইত্যাদি লাগানোর
জন্য তাঁর হাতের বহু জায়গায় কালশিটের মতো হয়ে গিয়েছিল। আমি সেখানে হাত
বুলিয়ে দিতাম। উনি ভালবাসতেন সেটা। নার্সকে বলেছিলাম ভাল করে তিন বার মলম
লাগিয়ে দিতে। জানতে চেয়েছিলাম, ‘‘খুব ব্যথা?’’ উনি বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ,
খুব।’’ কিন্তু নিজের রোগযন্ত্রণা নিয়ে কখনও কারওকে বেশি বিরক্ত করতে
চাননি। অথচ মুনমুন-রাইমা-রিয়া এবং চিকিৎসকেরা যে কী আন্তরিক পরিশ্রম
করেছেন ওনাকে সুস্থ করে বাড়ি ফেরানোর জন্য, তা আমি কাছ থেকে দেখেছি।
এই তো কয়েক দিন আগেই আমরা নিজেরা বলাবলি করলাম, উনি নিজেই যখন আর
হাসপাতালে থাকতে চাইছেন না, তখন রবিবার বাড়ি নিয়ে যাওয়াই ভাল। দরকারে
বাড়িতে হাসপাতালের মতো সব বন্দোবস্ত করে দেওয়া যাবে। তার আগে এক দিন
খিচুড়ি খাওয়ার কথাও হল। উনি খিচুড়ি খেতে ভালবাসতেন। বললাম, এই শীতেই এক
দিন খিচুড়ি রান্না করে আপনার বাড়ি নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে মজা করে খাব।
উনি শুনে হেসেছিলেন। দুর্ভাগ্য, কোনওটাই হল না।
তাঁর আরও একটি ভাল লাগার কথা জেনেছি। ‘হসপিটাল’ ছবিতে তাঁর লিপে গীতা
দত্তের গাওয়া ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়, এ কী বন্ধনে জড়ালে গো
বন্ধু’ খুব প্রিয় ছিল তাঁর। বলেছিলাম, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে এক দিন
আপনার বাড়ি গিয়ে ওই গানটি শুনিয়ে আসব। সব কথাই এখন স্মৃতি! আমাদের
সুন্দর বন্ধনে জড়িয়ে রেখে তিনি আকাশ মায়ের কোলে অন্য শান্তির নীড় খুঁজে
নিলেন।
গত কয়েক দিন ধরেই তাঁর শারীরিক অবস্থা খুব স্থিতিশীল ছিল না। সেটা
চিকিৎসকেরা তো বটেই, আমরাও বুঝতে পারছিলাম। তবু চেষ্টার ত্রুটি হয়নি।
শেষের ক’দিন কথা বিশেষ বলছিলেন না। তারই মধ্যে তাঁর মন ভাল করার জন্য মজা
করতে চাইতাম। খিচুড়ি খাওয়ানোর মতো হাল্কা প্রসঙ্গ তুলতাম। কিন্তু মনের
কোণায় একটি দুশ্চিন্তা দানা বাঁধছিল।
 বৃহস্পতিবার
সন্ধেবেলা নবান্ন থেকে বেরিয়ে বেলভিউ যাওয়ার পথেই ফোনে জানতে পারলাম,
তাঁর অবস্থা বেশ খারাপ। ডাক্তার মৈত্র, ডাক্তার নস্কর সকলেই ভেঙে পড়েছেন।
তবু গিয়ে তাঁদের সকলের সঙ্গে কথা বলে আমার মতো করে জোর দেওয়ার চেষ্টা
করলাম। তার পরে ঢুকলাম মহানায়িকার কেবিনে। তিনি চোখ খোলার চেষ্টা করছিলেন।
হাত ধরলেন। চোখের কোল বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে এল। চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র
তাঁকে বললেন, “চিকিৎসার কারণে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। ক্ষমা চাইছি।
আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।” আসলে মহানায়িকা নিজেও আর চাইছিলেন না, কষ্ট পেতে।
বরং স্বমর্যাদায় শান্তিতে তাঁর অভীষ্টলোকে চলে যেতে চেয়েছিলেন দ্রুত।
তাই রক্ত পরীক্ষার জন্য সূচ ফোটালে বিরক্ত হতেন। নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন বা
বাই-প্যাপ লাগাতে গেলে হাত সরিয়ে দিতেন। ভেন্টিলেশনে না-দেওয়ার কথাও
জানিয়ে দিয়েছিলেন আগেই।
এই অবস্থায় আমরাও জেনে গিয়েছিলাম, আর বেশি সময় নেই। তিনি আমাদের ছেড়ে
চিরতরে চলে যাবেন যে কোনও সময়। দু’দিন আগে থেকেই তাই পুলিশ কমিশনার,
চিকিৎসক সকলের সঙ্গে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করে রাখতে উদ্যোগী হই। সবটাই
গোপনে। কারণ কাজটি বড় নির্মম। তবু কর্তব্য তো করতেই হবে। আমরা চাইনি তাঁর
শেষ ইচ্ছার কোনও রকম অমর্যাদা করতে। তাঁর পরিবার যেমন বলবেন, সে ভাবে সব
করাটাই লক্ষ্য ছিল। মহানায়িকা নিজেকে জনবিরলে রেখেছিলেন। তাই শেষযাত্রা ও
অন্ত্যেষ্টির ব্যবস্থা আগে থেকেই এমন ভাবে তৈরি ছিল যাতে তাঁর মুখ
প্রকাশ্যে না আসে।
সুচিত্রা মানে কি শুধুই রোম্যান্টিক নায়িকা? গত কয়েক দিন তাঁকে কাছ থেকে
দেখার পরে আমি কিন্তু এক অন্য সুচিত্রা সেনকেও আবিষ্কার করেছি। রোম্যান্টিক
সুচিত্রা আমাদের সকলের মনের মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে আছেন, থাকবেন। আমরা
যুগ যুগ ধরে তাঁর সেই চাহনি, সেই প্রেমের আবেগ, সেই মিষ্টতায় আচ্ছন্ন হয়ে
আছি এবং থাকব। কিন্তু রোম্যান্টিক সুচিত্রা সেনের মধ্যে আরও এক জন আছেন।
যিনি তেজস্বিতায় ভরপুর, প্রতিবাদী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে
দাঁড়ানোর সুচিত্রা সেন। তাঁর অভিনীত ‘দেবী চৌধুরাণী’-তে সুচিত্রার
চরিত্রের এই দিকটি এমন ভাবে ধরা পড়েছে, যেটা কখনই অভিনয় বলে মনে হয়নি।
আসলে নিজের মধ্যে সেই মানসিক দৃঢ়তা ছিল বলেই অত প্রাণবন্ত হয়েছে তাঁর
অভিনয়। একই কথা বলব হিন্দি ‘আঁধি’ ছবি সম্পর্কেও। সেখানেও ইন্দিরা গাঁধির
চরিত্রের দৃপ্ত দিকগুলি নিজের মানসিক গঠনের ছকে ফেলে জীবন্ত করে তুলেছেন
সুচিত্রা সেন। আমাকে কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে
প্রতিবাদের জায়গা থেকে সুচিত্রা সেন কি আপনাকে বিশেষ নজরে দেখেছেন’? সেই
উত্তর তো আমার কাছে থাকার কথা নয়। যিনি জানেন, তিনি আজ অন্য লোকের যাত্রী।
তবে এটা বলব, আমাকে ডেকে পাঠানোর আগে তিনি নিশ্চয় আমার কাজের ধারা
সম্পর্কে একটু আধটু জেনেছিলেন। আমার মাথায় তাঁর আশীর্বাদের হাত তো আমি
পেয়েছি! সর্বোপরি তাঁর মনের দৃঢ়তা ছিল বলে মৃত্যু সম্পর্কেও এত উদাসীন
হতে পেরেছেন তিনি।
আর ছিল ধর্মের প্রতি অগাধ আস্থা। তিনি রামকৃষ্ণ মঠের দীক্ষিত ছিলেন, সবাই
জানি। কিন্তু তাঁর প্রতিদিনের কতটা সময় তিনি ধর্মাচরণে কাটাতেন, নিজের
ঠাকুরঘরে একান্তে পুজো-অর্চনায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন সেটা বলার মতো। এই
অসুস্থতার মধ্যেও নার্সিংহোমে মঠ থেকে ফুল ও চরণামৃত এসেছে তাঁর জন্য। তাঁর
শেষযাত্রার আগে এসেছেন মঠের সাধুরা।
তবে ‘মুডি’ ছিলেন খুব। মেজাজ খুশি থাকলে একেবারে হাসির ধারা। আবার কোনও
কারণে মুড ভাল না-থাকলে বা বিরক্ত হলে মুখের রেখায় চরম অভিমানের প্রকাশ।
আমি নিজেই এটা দেখেছি। যদিও সৌজন্যের মাত্রা কখনও ছাড়াতেন না। মৃত্যুর
দু’দিন আগেও আমাকে হাত তুলে নমস্কার জানাতে ভোলেননি। আর ফিটফাট ছিলেন এতটাই
যে, ঠোঁটের ক্রিমটাও ঠিকঠাক মাখিয়ে দিতে হতো।
সব শেষে সেই অনিবার্য প্রশ্ন। কেমন দেখতে ছিলেন এখনকার সুচিত্রা সেন? কেমন
চেহারা ছিল তাঁর? এই লেখার সেই গোড়ার প্রসঙ্গে ফিরি। আমাদের সকলের
স্বপ্নের নায়িকাকে প্রথম দেখতে যাওয়ার দিনে আমার মনেও এই কৌতূহল যে ছিল
না, বলি কী করে! আর গিয়ে কী দেখলাম? শুনলে আশ্চর্য হবেন, ওনার চেহারা
একেবারে আগের মতোই আটোসাঁটো। বয়স ছাড়া ভাঙনের ছাপ নেই। কারণ যাঁরা মাথা
উঁচু করে চলেন, তাঁরা তো ভাঙতে জানেন না। তাঁর মরদেহের সামনে দাঁড়িয়েও
সেই কথাটি বারবার মনে হচ্ছিল। একেবারে শান্ত, সুন্দর মুখ, যেন নিশ্চিন্তে
ঘুমিয়ে রয়েছেন।
নিজস্বতায় অনড় থেকে এই চলে যাওয়া তাঁকে চিরজয়ী করে রাখল। আমরা শুধু সেই জয়ের সাক্ষী থাকলাম।
|
ছবি: দীনেন গুপ্ত। সোনালী গুপ্ত বসু-র সৌজন্যে প্রাপ্ত। |
No comments:
Post a Comment